মুহাম্মদ ওমর হামজা:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য যিনি নিজের উত্তম নাম সমূহের একটিকে ‘আস-সালাম’ বা শান্তি দাতা ঘোষণা করেন। দরূদ ও সালাম শান্তির অগ্রদূত বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যিনি সালাম প্রসারের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর পরিবার-পরিজন ও মহান সাহাবায়ে কেরামের উপর যাঁরা নিজেদের মধ্যে সালাম বিনিময়ে অকপট ছিলেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারঁই বান্দা ও রাসূল। অতঃপর … …. …
সম্মানিত সমবেত ভাইগণ,
আল্লাহ তা’আলার অশেষ রাহমতের উপর ভরসা করে বিগত জুমুআ’র মত আজকের খুতবা ও ইসলামি সমাজ জীবনের অতি ঘনিষ্ট এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম একটি বিষয় ‘সালাম’ নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করার ইচ্ছা করছি। আসলে মানব সভ্যতার শুরু হতেই পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় অভিবাদনের রীতি পদ্ধতি পালিত হয়ে আসছে। রাসূলে আকরম (স) ইরশাদ করেন, সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা আদি পিতা আদম (আ)কে বিশেষ অবয়ব ও আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন । আল্লাহ তা’আলা তাঁকে স্বীয় কুদরাতে পিতা-মাতা বিহীন সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির পর আল্লাহ তা’আলা তাঁকে উপবিষ্ট একটি ফেরেশতা দলকে সালাম করতে বলেছেন। আর বলেছেন, তারা তোমার সালামের জবাবে যে উত্তর প্রদান করে সেটিই পৃথিবীতে তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম প্রদানের অর্থাৎ অভিবাদনের তরীকা হবে। আল্লাহর বলেন: ” আর কাজেই তাদের উত্তরটি মনযোগ সহকারে শ্রবণ করবে। আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক হযরত আদম (আ) ফেরেশতা দলের নিকট গিয়ে ‘ আসসালামু আলাইকুম ‘ (তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বললেন। তারা জবাবে বললেন ‘ওয়া আলাইকা আসসালামু ওয়া রাহমাতুল্লাহ (তোমার উপর ও শান্তি ও আল্লাহর করুণা আরোপিত হোক) সুতরাং দেখা গেল যে, ফেরেশতারা জবাবে (ওয়া রাহমাতুল্লাহ) বাক্যটি বৃদ্ধি করলেন। তখন থেকেই সালামের সূচনা হয়। তবে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতি নিজেদের আদর্শ ও রুচি অনুযায়ী বিভিন্ন শব্দ ও রীতি ব্যবহার করে থাকে। প্রাক ইসলামি যুগে আরবরা সাক্ষাতের সময় এক অপরকে অভিবাদন করত। সাধারণতঃ তারা নিম্নোক্ত তিনটি বাক্য ব্যবহার করত। (ক) আন’আমা সাবাহান (সুপ্রভাত) (খ) আন’আমা মাসাআন(শুভ সন্ধ্যা) (গ) আন’আমাল্লাহু আইনান (আল্লাহ আপনার চক্ষু ঠান্ডা করুন) ইসলামের আবির্ভাবের পর মহানবী (স) প্রাক-ইসলামি যুগে ব্যবহৃত শব্দগুলো বাদ দিয়ে পরস্পরকে অভিবাদন করতে আসসালামু আলাইকুম এবং আলাইকুমুসসালাম শব্দ ব্যবহার করতে আদেশ প্রদান করেন। আর অমুসলিগণ তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি অনুসারে তাদের পারস্পারিক সাক্ষাতের সময় অভিবাদন করে থাকে। যেমন হিন্দুগণ নমস্তে, নমস্কার,আদাব ইত্যাদি বলে থাকে এবং ইংরেজগণ, Good morning.Good evening. Good night. ইত্যাদি শব্দ বলে থাকে।
সুহৃদ ভাই ও বন্দ্ধুগণ,
মহানবী(স) ‘সালাম’ শব্দ দ্বারা অভিবাদন/ অভ্যর্থনা প্রচলনের আদেশ দানের গূঢ় অর্থ ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে হলে ‘সালাম’ শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক এবং বহুমাত্রিক অর্থ বুঝা বা উপলব্ধি করা দরকার। সালাম অর্থ : ১.দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত থাকা। ২.নিরাপত্তা দেয়া। ৩. শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা, সূরা আন’আমে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদর জন্যে আছে শান্তির আবাস”। ৪. স্বাগতম ও অভিবাদন জানানো। আল্লাহ সূরা ইউনুসের ১০ নম্বর আয়াতে বলেন: ” আর সেখানে তাদের অভিবাদন হবে ‘ সালাম’।” আল্লাহ তা’আলা সূরা যূমারের ৭৩নম্বর আয়াতে বলেন: ” তোমাদের প্রতি ‘ সালাম’ তোমরা সূখি হও এবং জান্নাতে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে অবস্থিতির জন্যে “।আল্লাহ তা’আলা সূরা ইয়াসনের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলেন, ” ‘সালাম’ পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ হতে সম্ভাষণ” ৫.আনুগত্য প্রকাশ করা ও সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা।
আল্লামা রাগেব ইস্পাহানী (র)বলেন, সালাম শব্দটি আল্লাহর একটি নাম। কেননা আল্লাহ যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। সূরা হাশরের ২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ” তিনিই আল্লাহ যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি “।
পরিভাষায় মুসলমানদের পরস্পর সাক্ষাতে ‘আসসালামু আলাইকুম ‘ বলে দোয়া কামনা, নিরাপত্তা দান ও কুশল বিনিময় করাকে সালাম বলা হয়।কাউকে আসসালামু আলাইকুম বলে সম্বোধন করার অর্থ হলো (ক)আল্লাহ তা’আলা তোমার অবস্থা সম্পর্কে অবগত, সুতরাং তুমি তার ব্যাপারে অমনযোগি হয়ো না। (খ) তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, আমার পক্ষ থেকে তোমাকে নিরাপত্তা দেয়া হল। তুমি ও আমাকে নিরাপত্তা দান কর। (গ) আল্লাহর ‘সালাম’ নামটি তথা তাঁর নিরাপত্তা তোমার জন্য অবধারিত হোক। যেমন আমরা বলে থাকি ‘ আল্লাহ তোমার সাথে আছে’। এ মর্মে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) হতে বর্ণিত রয়েছে – ” আল্লাহ তা’আলার নামের মাঝে সালাম একটি নাম। আল্লাহ জমিনে স্বাপন করেছেন, তোমরা তোমাদের মাঝে সালামের ব্যাপক প্রচলন কর “। এটা বাস্তব যে,বর্তমান আধুনিক প্রগতির যুগেও পরস্পর সাদর সম্ভাষণের জন্য ‘আসসালামু আলাইকুম’ এর চেয়ে উত্তম কোন সম্প্রীতিমূলক শব্দ বা বাক্য আবিষ্কৃত হয়নি। ইসলাম যেমন সার্বজনীন ও আন্তর্জাতিক ধর্ম তেমনিভাবে এর প্রতিটি কাজ -কর্ম নিয়ম-শৃঙ্খলা সার্বজনীন। সত্যিই এ বাক্যের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, যা ছোট-বড়, আমির-গরীব সকলের ক্ষেত্রে এবং সব সময় প্রযোজ্য। যেমন – আল্লাহ তা’আলা নিজেই তাঁর নবীকে সম্ভাষণ জ্ঞাপন করে বলেছেন-‘আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান নবী ‘। সুতরাং আমরা অনায়াসে বলতে পারি যে, ‘আসসালামু আলাইকুম’ শব্দের চাইতে উত্তম কোন বাক্য নেই।
সমবেত মুসলিম-মু’মিন ভাইগণ,
ইমাম মুসলিম (র) সাহাবী আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত হাদীসে বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরাঈৃান গ্রহণ করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন এক কাজের প্রতি পথ দেখাব না? যা তোমরা করলে পারস্পরিক ভলবাসা বৃদ্ধি পাবে। (সেটি হল) তোমরা নিজেদের মাঝে সালামের ব্যাপক প্রচলন কর। আসলে সালাম ইসলামের অন্যতম শি’য়ার তথা জাতীয় প্রতীক। ওলামায়ে কিরামের ইজমা হয়েছে যে,সালাম দেয়া সুন্নাত, আর উত্তর দেয়া ওয়াজিব। আল্লাহ তা’আলা সূরা নিসার ৮৬ নম্বর আয়াতে বলেন, ” তোমাদের যখন অভিবাদন করা হয় তখন তোমরা ও তা অপেক্ষা উত্তম প্রত্যাবিদান করবে বা তারই অনুরূপ করবে, নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী “। বস্তুত সালাম হচ্ছে ভালবাসা সৃষ্টির ও বৃদ্ধির প্রথম মাধ্যম ও সেতু বন্ধন। এতে ভালবাসা গভীর হয়ে থাকে। আর সালাম হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মনের অবস্থার বহিঃপ্রকাশ এবং এট ব্যাপকতা হচ্ছে ব্যাপক ভ্রাতৃত্বের যোগ সূত্র। অতএব, পরিচিত ও অপরিচিত সব মুসলমানকে সালাম দিতে হয়। তবে, সালাম দানের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (স)এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও পদ্ধতি রয়েছে যে,কে কাকে সালাম দিবে।তা কিন্তু ইসলামি শিষ্টাচার ও রীতি-নীতির অপরিহার্য অংশ। এখানে যে সকল অবস্থায় সালাম দেয়া মাকরূহ তা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য :
১.নামাযরত অবস্থায়। ২. পানহার অবস্থায়। ৩.মল-মুত্র ত্যাগ অবস্থায়। ৪.কুরআন পাঠ তথা তিলাওয়াত অবস্থায়। ৫. ওয়ায-নসীহত কিংবা পাঠদান অবস্থায়। ৬.যিকর-আযকারে মশগুল থাকা অবস্থায়। ইসলামে সালাম প্রথা প্রবর্তনের পেছনে কতিপয় উপকারিতা রয়েছে। যেমন — ১. অপরিচিত লোকের সাথে পরিচয় ঘটে। ২.অপরিচিত ব্যক্তিকে সহজেই আপন করে নেয়ার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সালম। ৩. পারস্পরিক হিংসা -বিদ্বেষ, শত্রুতা ও মনমালিন্য বিদূরিত হয়। ৪. পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি হয়। ৫.সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। ৬.সালাম বিনিময়ে অনেক সাওয়াব ও আল্লাহর রহমত অর্জিত হয়। ৭. সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে উঠে। ৮. সালাম দ্বারা শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জিত হয়। ৯. বিধর্মীদের অন্তরে সালামের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ১০. সর্বোপরি পরস্পর সালাম বিনিময় হল রাসূল (স)এর একটি সুন্নাতকে জীবিত করা হয়। পরিশেষে, অকাট্যভাবে জানা হল যে, সালাম আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক প্রদত্ত একটি বিধান, যা সৃষ্টির সূচনাতেই।আদম(আ)কে শিখানো হয়েছে । প্রত্যেক নবীর শরীয়তে এর প্রচলন ছিল। আমাদের বাস্তব জীবনে সালামের প্রচলন করা একটি অপরিহার্য কর্তব্য। বর্তমান মুসলিম প্রজন্মের মধ্যে এর ব্যাপক প্রচলন দেখা যায় না। মূলতঃ দ্বীনি চেতনা না থাকায় সালামের ব্যাপকতা হ্রাস পেয়েছে। অজ্ঞ জাহিলদের আচরণের জবাবে সূরা ফুরকানের ৬৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “রাহমান এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের যখন অজ্ঞ ব্যক্তরা সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’।
মুহাম্মদ ওমর হামজা
অধ্যক্ষ (অবসর প্রাপ্ত) খুটখালী তমিজিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।